লেঃ কর্নেল গুণীন্দ্র লাল ভট্টাচার্য
৩/১/৭৮
আমার ছোটবেলার কথা? বেশ তাই হোক।
তিন বছর বয়সের আগের কথা কিন্তু আমার মনে নেই। মার কাছে শোনা যে ১০ নং রাধানাথ বোস লেন গোয়াবাগান সকাল ৯টা ২০ মিনিট। (কলকাতার সময় তখন ২৪ মিনিট আগে থাকতো Rail Time এর চেয়ে যাকে বলা হতো Indian Standard Time।) বুধবারে আমার জন্ম বাংলা ৮ই ফাল্গুন, ১৩২৪ বঙ্গাব্দ, ইংরাজী ২০ শে ফেব্রুয়ারী ১৯১৮ সালে। আমার ঠাকুরদাদা (মতিলাল ভট্টাচার্য) আমার নাম দেন গুণীন্দ্রলাল। এই সময় আমার বাবা (সিন্ধুলাল) Meerut-এ কাজ করতেন।
তারপর মিরাটে শৈশব কাটে। এখানে আমার বাবা মিলিটারি অ্যাকাউন্টস এ কাজ করতেন। ১৯২১ সালে আমি প্রথম রেঙ্গুনে যাই। বাবার চাকরী বদলি হয়ে Accountant General Burma, Rangoon-এ হওয়ায় তাঁকে ওখানে যেতে হয়।
অবশ্য এর আগে ১৯১৩ থেকে ১৯১৭ পর্যন্ত বাবা মা রেঙ্গুনে ছিলেন।
এই জাহাজে যাওয়ার দৃশ্য আমার প্রথম স্মৃতি। মনে পড়ে কাঠের ডেকে আমি আর আমার ছোট বোন হেমলতা চলতে চেষ্টা করছি, কিন্তু কিছুতেই এক জায়গায় দাঁড়াতেই পারছি না। জাহাজ দুলছে আর আমরা বাধ্য হয়ে রেলিং ধরছি, ছাড়লেই প্রায় পড়ে যাচ্ছি। ঝড় বা বৃষ্টি ছিল না। বাবা আমাকে ডেকের (deck-এর) পিছন দিক দেখালেন। একজন কেউ মারা গিয়েছিলো— তার সমুদ্রে burial হবে। কয়েকজন ইংরেজ আর কিছু ভারতীয়,—একটা বড় coffin তার ওপরে কালো একটা বড় কাপড় দিয়ে, coffin-এর চারিদিক মোড়া— এর দুধারে দাঁড়িয়ে। একটা বই থেকে প্রার্থনা পড়া হলো, সকলে মাথা নিচু করে চুপ হয়ে শ্রদ্ধা জানালো। তারপরে সেই বড় কালো কাপড়ে মোড়া coffinটা দেখলাম দড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে ওপরে উঠল আর deck-এর Railing-এর ওপর দিয়ে তাকে ধীরে ধীরে সমুদ্রে নামিয়ে দেওয়া হলো। অল্প পরেই সকলে চলে গেলে আমি Railing ধরে জাহাজের পিছনে দেখতে গেলাম। তখন দড়িও নেই, সেই coffinটাও ডুবে গিয়েছে। তবে অনেকগুলি হাঙ্গর জাহাজের পেছন পেছন আসছিল। বাবা বললেন আগে সমুদ্রে ডুবোজাহাজ ও থাকতো আর জাহাজের নিচ থেকে আঘাত করে জাহাজকে ডুবিয়ে দিত গর্ত করে। আমি তখন ডুবো জাহাজ দেখবার জন্য রেলিং ধরে রইলাম— আর ভাবতে লাগলাম সেই কাল কাপড় মোড়া বাক্সের কথা। যে লোকটি মারা গিয়েছিলো সে নাকি জাহাজের একজন নাবিক।
এই আমার শৈশবের প্রথম স্মৃতির কথা।
রেঙ্গুনে ছিলাম আমার পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত। আমরা আমার জ্যাঠামহাশয়ের সঙ্গে একটা কাঠের বাড়ির দোতলায় থাকতাম। নিচে একটু পাশে একটা চীনেদের খাবার হোটেল ছিল। আমাদের রান্না করে দিত ইন্দ্রঠাকুর। সে আমার খুবই প্রিয় বন্ধু ছিল। এইসময়ের মাত্র কয়েকটা ঘটনা মনে পড়ে।
আমার বাবাকে খুব স্পষ্ট দেখতে পাই। তিনি শুয়ে সন্ধ্যায় হারিকেন বাতির আলোয় সুর করে মহাভারত পড়তেন আর আমি মাথার কাছে বসে শুনতাম আর বইটির দিকে দেখতাম যদি আমিও পড়তে পারি। গম্ভীর,
১স্পষ্ট স্বর। পরে আস্তে আস্তে আমার মুখস্ত হয়ে যেতে লাগলো। আমিও কয়েকটা আখ্যান বলতে লাগলাম— আমার প্রিয় ছিল ভীম ও দুর্যোধনের গদাযুদ্ধ। বাবাকে সকলেই ভয় করত ও তাঁর রাগ হলে সকলে পালিয়ে লুকোত— আমিও একটা টেবিলের তলায় লুকোতাম। একবার শুধু বাবা যেন খেলার ছলেই আমায় ধরে ফেলেন আর শাস্তি দেবার জন্য চুল ধরে উঠনের মধ্যে নিয়ে আসেন। মার খাইনি তবে ভয় দেখানোর যে ইচ্ছাছিল তা সাৰ্থক হয় ।
এই সময়ে মার কাছে আমি বাংলা লিখতে ও পড়তে শেখা আরম্ভ করি। একদিন আমার ঠাকুমার কাছ থেকে একটি চিঠি পাই। সেটা শুনে আর পড়বার চেষ্টার পর আমার তাঁকে খুবই মনে পড়ল— তাঁর স্নেহের পরশ, তাঁর ডাক— গুণধর। কারুকে কিছু না বলে আমি তাঁকে একটি কাগজে আমার মনের কথা তাঁকে লিখি— আমি দেখেছিলাম যে একজন যাকে সকলে Postman বলতো সে চিঠি নিয়ে আসে। তাই একদিন সকালে — চিঠি লেখার পরদিন তার প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলাম। সে ওপরে উঠতেই, কারুকে ডাকবার আগেই— আমি তার কাছে গিয়ে আমার লেখা কাগজটা দিয়ে ভাঙা হিন্দিতে তাকে বোঝালাম যে সে যেন কলকাতায় আমার ঠাকুমাকে আমার চিঠিটা দেয়। আমার ঠিক ধারণা যে সেই তো ঠাকুমার চিঠি নিয়ে এসেছে আমার জন্যে— তাই সে নিশ্চয় তাঁর কাছে যায় ও তাঁকে জানে। সে অবাক হয়ে আমায় দেখল, আর তার মুশকিল আছে বলতে চেষ্টা করছিল— আমি তাই ভাল করে তাঁকে বোঝালাম সেই যে আমার ঠাকুমা, যিনি কলকাতায়, যাঁর চিঠি সে এনেছিল কাল তাকেই এটা দিতে হবে। এবার কিন্তু সে হেসে ওঠে ‘বাবু’ ‘মাইজি’ বলে হাঁক দিল— পোস্ট ম্যান বলে। তখন মা আর অন্য সকলে, আমার জ্যাঠামশাইয়ের বড় ছেলেমেয়েরা এসে পোস্টম্যানের কাছে সব কথা শুনে সকলেই হাসতে লাগলো। আমাকে বোঝাতে লাগলো জাহাজে করে ব্যাগ যায় আরও কত কী। এইটুকু বুঝলাম যে এই পোস্টম্যান আমার ঠাকুমাকে চেনে না বা তাঁর কাছে যায় না। এছাড়া আর কিছুই আমার শুনবার অবস্থা ছিল না। ঠাকুরমার জন্য আমার লুকোনো, আমার গোপন ভালোবাসা যে প্রকাশ হয়ে গেল, আর আমার ছোট লেখাটা যে কতই তার অল্প প্রকাশ এই বুঝে ও ভেবে লজ্জায়, আমার অজ্ঞানতা এবং ক্ষুদ্র ক্ষমতার প্রমাণে খুবই সঙ্কুচিত হয়েছিলাম। আর কখনো এত মন প্রাণ দিয়ে এত গোপনে এত অল্পে নিজের মনকে উজাড় করতে ইচ্ছা হয় নি। আর এটা অন্যদের কাছে হয়েছিল উপহাসের ব্যাপার। মনে হয়েছিল বড়রা তো ছোটদের কিছুই বোঝে না। সেই পোস্টম্যানের কাছে আমি আর কখনো আসি নি। Childmind-এর নিজের একটা logic আছে, যা তার জ্ঞান ও কল্পনাপ্রসূত। বড়দেরও তাই। স্বপ্নেরও নিজস্ব logic থাকে। বোধহয় যে ছোটদের সেই childmind-কে শ্রদ্ধা করতে পারে, সে তাকে ধরতে পারে আর ছোটদের জগতে প্রবেশ করতে পারে অন্ততঃ। তাদের শ্রদ্ধাভাজন হয়— কারণ বোঝার সঙ্গে আসে বন্ধুত্ব উপহাস নয়। ৭/১/৭৮
II
স্মৃতির চোখে নিজেকে ছোট দেখি। বাংলা লেখা ও একটু পড়ার সঙ্গে ঠিক হল আমি স্কুলে যাব—যে স্কুলে আমার জ্যাঠামশায়ের ছেলে মেয়েরা পড়তো— শুনেছি বেঙ্গল অ্যাকাডেমি। যাই হোক ইন্দ্রঠাকুরের কাঁধে চড়ে আমি স্কুলে গিয়েছিলাম। প্রথমদিন একটা ক্লাসের শেষ বেঞ্চে আমি আমার এক দিদির পাশে বসেছি। সামনে ৩টি আরও বেঞ্চ আর এক বড় সাদা দাড়ি বিশিষ্ট চশমা পড়া লোকটা পড়াচ্ছেন। তিনি কী বলছিলেন কিছুই বুঝিনি আর মনেও নেই। লক্ষ করি যে মাঝে মাঝে একজন করে বাইরে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করে জানলাম যে তারা জলখাবার জন্য অনুমতি নিয়ে ক্লাস থেকে যেতে পারছে। অমনি আমার খুব জলতেষ্টা পেয়ে গেল— বিরক্ত হয়ে আমার ছোট্ট দিদি আমাকে বাইরে নিয়ে গেলেন যেহেতু তিনিও ফিরে আসবেন তাই আমাকেও অনিচ্ছাসত্ত্বেও আস্তে হল ভেতরে। একটু পরে আবার জলতেষ্টা পেল তখন কিন্তু আমার দিদি আর যাবে না— আমাকে চুপ করতে বলল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তো আমি কী করব এত জলতেষ্টা পেয়েছে। সে আমায় আমার হাতাটা চুষতে বলল— আমি তাই করতে লাগলাম— আর ক্লাস শেষ হতে হতে আমার শার্টের ডান হাতাটি সবই ভিজে—ভাড়ি জলতেষ্টা বোধহয়। মোটকথা বেশ মনে আছে আমি আমার দিদির কথা একদম বিশ্বাস করেছিলাম আর মনে হয়নি যে জলতেষ্টা এতে যাবে না।
পরদিন স্কুল যাবার ঠিক আগেই আমি বাথরুমেবসে। সকলে ডাকছে। আমি চুপ করে আছি, খুব আশা— তারা চলে যাবে। আমার মা কিন্তু ঠিক আমায় আবিষ্কার করলেন তারপর জামাকাপড় পড়ে ইন্দ্রঠাকুর আমায় নিয়ে গেল। ইন্দ্রঠাকুরের কথাতেই রাজি হয়েছিলাম— বেড়াব ভেবে। অন্যরা অবশ্য এর আগেই চলে গিয়েছে। ও আমাকে সেই স্কুলেই নিয়ে গেল। আমি কিছুতেই ভিতরে যাব না। ওকেও ছাড়ব না। তখন দির্ঘাঙ্গী সুন্দরী এক মহিলা বারান্দায় এসে আমায় ডাকলেন। ওকে আমার ভালই লাগলো কিন্তু উনি তো আর আমায় পড়াবেন না । ক্লাসের শিক্ষক সেই দাড়িওয়ালা, শুষ্ক ভদ্রলোক। কোনও আকর্ষণ ছিল না যাবার— ভয় ছিল না, ছিল rejection। মহিলাটি স্কুলের Headmistress, বেশ হেসেই বললেন কেন চলে যাচ্ছ, এস। বললাম আমার পেট ব্যাথা করছে যে। তখন উনি বললেন, এখানে তো বাথরুম আছে, কোনো মুশকিল হবে না। এর প্রতিবাদ করতে ইচ্ছা হল না। বলে ফেললাম, তা হলে আমার বমি পাচ্ছে যে। তখন উনি হেসে ফেললেন। ওর হাসি ও বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা ভাল লেগেছিল ও এখনো ভুলতে পারিনি। বোধহয় কাছে এসে যদি বলতেন আমার কাছে বসে ছবি দেখবে, বা গল্প করবে, তো আমি নিশ্চয় কথা শুনতাম। যাই হোক তারপর ইন্দ্রঠাকুরের কাঁধে আমি বাড়ি ফিরি। বাড়িতে সকলে বলতে লাগলো, যে আমি স্কুল পালাই। তাতে আমার কিছু বিরক্তি বা লজ্জা হয় নি। আমার স্কুল একদম ভালো লাগেনি।
এরপর মনে আসে আরও একটি দৃশ্য। নৌকার উপর আমি আর ইন্দ্রঠাকুর, কিনারা থেকে নৌকা একটু দূরে— কিছুদূরে নৌকার আস্তে আস্তে নাচতে ও দোলা খেতে লাগলো। আমি দেখছি যেখানে ইন্দ্রঠাকুর দেখাচ্ছে ওই সমুদ্র। কত দূর পর্যন্ত জল আর জল, ঢেউ আর ঢেউ— অবাক হয়ে দেখছি যেদিকে কোনো শেষ নেই। দেখতে দেখতে নিশ্চই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কারণ পরে শুধু মনে আছে নৌকা থেকে নামা, ইন্দ্রঠাকুরের কাঁধে বসে আছি আর ও আমার হাত দুটো ধরে আছে। আমি ওর মাথায় নিজের গাল রেখে যেন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ওর গলার স্বরটি শুনতে পারছি।
এরপরে মধ্যে মনে পরে টুকটুকির বাড়ি যাওয়া। টুকটুকি একটি ছোট মেয়ে— আমারই মত— আমার কিন্তু ওর মাকেই মনে আছে। তিনি পিয়ানো বা অর্গান বা Pedal Harmonium বাজাতেন— সেইটি শুনতে দোতলায় বেশ উঁচু সিঁড়ি উঠে যেতে আমার আগ্রহের শেষ ছিল না।— সেখান থেকে বাড়ি আসার ইছাও করত না। ইন্দ্রঠাকুরই আমায় নিয়ে আসতে পারতো।
এরপর একটা শোনা কথা তাঁকে আমার মনে পড়ে না। শ্রী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাবার অফিসে কাজ করতেন।। তিনি বিশেষ কর্মপ্রিয় ছিলেন না, অফিসের কাজ করার ব্যাপারে। তাঁর জগত ছিল অন্য, তাই তিনি যেন কিরকম একজন অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। তার কথা মাঝে মাঝে বাড়িতে হতো। শুনেছি তিনি কয়েকবার
বাড়িতে এসেছিলেন ও আমার নাম ও আমার ছোট বোনের নাম নাকি তাঁর ভাল লেগেছিল। পরে তাঁর বই “পথ নির্দেশ” এ দেখি তার মুখ্য চরিত্র গুণী ও নায়িকা হেমনলিনী, আমার ও আমার ভগিনীর নাম দুটি উল্লেখ করা হয়েছে। ৮/১/৭৮
III
রেঙ্গুন থেকে আমরা চলে আসি ১৯২৩ সালের প্রথম দিকে। ফিরে আসার কথা কিছুই মনে নেই। দুর্গাপূজা পর্যন্ত আমরা কলকাতায় ছিলাম আর এই সময়ের কথা গোয়াবাগানের রাধানাথ বোস লেনের বাড়ীর।
আমার ঠাকুরদা দাবা খেলতে ভালবাসতেন। রাজপুতানায় উদয়পুর রাজ্যে যুবরাজের তিনি ছিলেন Private Tutor আর সেখানকার Director of Public Instruction। তার পূর্বে Agra College এ সংস্কৃত ও Philosophy পড়াতেন। সেখানে আমার বাবার জন্ম হয়েছিল ১৮৮৮ সালে। আমার ঠাকুরদাদাকে ‘বাবু’ বলতাম। তিনি বই লিখতেন আর নিজেকে একটা কঠোর নিয়মে রাখতেন। পাঁচটি ছেলে প্রত্যেকেই গেজেটেড অফিসার তাঁদের সাহায্যে আর নিজের পেনশনে তিনি খুব আনন্দেই থাকতেন।
রবিবার দাবাখানার আসর বসত। আসতেন আমার ঠাকুরমার এক ভাই। তাঁকে আমরা রেজমামা বলতাম। দুজনের খেলা খুবই উত্তেজনাময় হতো— নানা রকম পরিহাস, অঙ্গভঙ্গি ও তীব্র প্রতিযোগিতা। আমি পাশে বসে দেখতাম ঘন্টার পর ঘণ্টা, বেশ উপভোগ করতাম কথাবার্তা ও মাঝে মাঝে উলুধ্বনি। বিশেষতঃ যখন রেজমামা ঠাকুরদাদার চালে হার স্বীকার করতে বাধ্য হতেন। আর যখন ঠাকুরদাদা তাঁর bathroom-এ ঢুকতেন তাঁর হারের মতন অবস্থায় উপস্থিত হলে, তখন রেজমামার কী উল্লাস ও কী ঠাট্টা। একটা বড় হলে ‘বাবু’র ঘরে খেলা হতো।
এরপরে মনে পড়ে পাড়ার জমিদার বাড়ির পুজোর কথা। বিশাল বড় মন্ডপ বাড়ির ভিতর। ওপরে প্রতিমা একটু নিচে বড় উঠোন মত— সেখানে বলি দেওয়া হতো। ভাল পোশাক পড়া কত লোক ধুনোর ধোঁয়া আর বাজনা। তারি মধ্যে প্রচণ্ড চিৎকার করে একজন বড় খাঁড়া নিয়ে বলির জন্য তৈরি। দুজন লোক একটা একটা করে ছাগল নিয়ে আসত। তাদের মাঠে এক জায়গায় আটক করা হতো তারপর পুরোহিত মহাশয়ের আরতির সাথে ঘণ্টা, ঢোলের আওয়াজ আর ‘জয় মা’ বলে এক কোপে বলি হতো। একজন রক্তাক্ত মুন্ড নিয়ে ছুটে গিয়ে প্রতিমার পায়ে তা অর্পণ করত। মহাষ্টমীর দিন অনেকগুলি বলি পড়তো। একদিন তারপর, আর আমার বেশি ভাল লাগে নি ও যাইনি। বেশিক্ষণ থাকিওনি। ঠাকুরদা বলতেন তিনি এই রূপ পূজায় বিশ্বাস করতেন না। বৈদিক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এইরূপ পূজা নাকি করে না।
এরপর একদিন দুপুরে আমাদের একটা ছবি তোলা হল। বাবার ইচ্ছা দিল্লি যাবার আগে তাঁর বাবা মার সঙ্গে আমাদের সকলের ছবি হবে। বাড়ির ছাতে ছবি তোলা হবে। আমাদের নতুন পোশাক খাকি হাফ প্যান্ট ও শার্ট। আমরা ৭ ভাই বোন আর ঠাকুরদা, ঠাকুমা, পিসিমা (ঠানদিদি), বাবা আর মা। আমার দাদা ঠাকুরদার কাছেই থাকতেন ও কলকাতায় পড়তেন Scottish Church College এ Matriculation। তিনি তখন ঘুমচ্ছিলেন— আমি নিচে তাঁকে ডাকতে গিয়েছিলাম। বিরক্তিমুখে তিনি এলেন— তাঁর ভুরু কোঁচকানো মুখটি মনে পড়ে, ছবিতেও তা বেশ ঠিকই উঠেছিল।
এই ছাতটি বেশ মজার জায়গা ছিল। বিকেলে কাচা জামাকাপড় ওঠানোর পর এখানে বাড়ীর মেয়েরা— মা, বৌদিরা, পিসি, বড়দিদি সকলে মাদুর পেতে চুল বাঁধতে বসতেন। একজন অপরের বাঁধতেন— নানারকমের খোঁপা বাঁধা হতো— পাতাকাটা ইত্যাদি, কতরকম হাসি ও কথা বুঝতাম না কিছুই। তবে কে কাঁটা আনেনি— কার চিরুনি ঘরে আছে, কার আরেকটি ফিতা চাই, এইসব আমায় আনতে হতো। সন্ধ্যায় এইখানেই পরিষ্কার করে দরী পাতা হতো। আর আমার বড়জ্যাঠামশাই-এর ছেলে একটি বড় চোঙ্গ দেওয়া গ্রামাফোন বাজাতেন— নানারকম পালা বাজানো হতো সকলে খুব আনন্দে শুনতেন। আমার খালি মনে হতো, বাঁকের ভিতর থেকে যে গান করে, তাকে কেমন করে দেখবো। মাঝে মাঝে চোঙের মুখের ভিতরে দেখবার চেষ্টা করতাম। আমায় বলা হয়েছিল ভিতরে গায়ক গায়িকা থাকে। তাই বিশ্বাস করতাম আর অপেক্ষা করতাম যদি বেরিয়ে আসে দেখবো।
এইরকম ভাবে দিনগুলি কেটে যেত। একদিন আমি একজনের সঙ্গে হেদুয়ার মোরে গেলাম। গাড়ি ঠিক করতে। তখন সেখানে ঘোড়ার গাড়ির স্ট্যান্ড ছিল। তিনটি গাড়িকে বলা হল হাওড়া স্টেশন এ যাবার জন্য পরদিন।
তখন দিল্লি যেতে তিনদিন লাগতো। ঘোড়ার গাড়ি করে আমরা রওনা হলাম। বাড়িতে মা ও ঠাকুমার কান্না দেখে অবাক লাগলো। ঠাকুরমা আমাকে অনেক আদর করলেন ও একটা টাকা দিলেন। তারপর স্টেশনে আসা, ট্রেনে চড়া ও দিল্লি যাওয়া। রাস্তায় অনেক স্টেশন। বাবার যেন সবই জানা— কোন স্টেশন এ কী খাওয়া ভাল– কোথায় গরম পুরী, কোথায় রাবড়ি, কোথায় বরফি। আমাদের একটা ছোট কামরা রিজার্ভ ছিল। Third class তবে রিজার্ভ থাকায় আমরা বেশ আরামেই আসছিলাম। মারই বিরক্তি, বাবা অনেক খাবার কিনছেন, উনি বলছেন দরকার নেই। তবুও আমরা সবই সাবাড় করে দিয়ে মাকেই অপ্রস্তুত করছি। বাবা নিজের বুদ্ধির প্রশংসা করছেন, আর আমাদের তো খুবই মজা। খাওয়ার লোভে বাবাকে ঠিক দেখবার জন্য, আমরা কিছুই বাকি রাখছি না।
দিনের বেলা মনে পড়ে বিহার থেকে দুপাশে ধূ ধূ করছে শুকনো মাঠ আর লাইনের সাথে সাথে কাছেই চলেছে অসংখ্য মনসা গাছ। অনেক দূরে কিছু গ্রাম ও বড় বড় গাছ যেগুলি আমাদের সঙ্গেই দৌড়ে চলেছে।
তৃতীয় দিন সকালের দিকে দিল্লি পৌঁছলাম। সেখানে বাবার অফিসের দুজন সহযোগী স্টেশনে এসেছিলেন। সেখানে নেমে দুচাকার ঘোড়ার গাড়ি টঙ্গা করে আমরা রাইসিনা পৌঁছালাম। ২৩ এ অক্টোবর ১৯২৩ সালে ৯ নং রিজ রোডে আমরা প্রথমে দিল্লিতে থাকি। বাড়িতে রান্নার সব ব্যবস্থা ছিল— আমাদের সঙ্গে দামোদর বলে একটি চাকর এসেছিল— মা সব ঠিক ঠাক করে আমাদের খাইয়ে দিলেন। তারপর সন্ধ্যায় আমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম। বাড়িটা বেশ বড়, ভিতরে ছোট বাগান। খাটা পায়খানা, অফুরন্ত জল। সামনেই Dairy ও ছোট পাহাড় যাকে Ridge বলা হতো। এই আমার দিল্লি আসা পর্যন্ত স্মৃতি। আমার বয়স পাঁচের উপর ছয়ের কম। এই বাড়িতে আমরা প্রায় পাঁচ বছর ছিলাম।
এবারে Ridge Road-এ থাকার সময়ের কয়েকটা গল্প। এখন নাকি এই রাস্তার নাম Mandir Maarg | তখন রাজধানীর আসন ছিল সিমলাতে। রাইসিনা তৈরি হচ্ছে। Legislative Assembly-র বড় বড় থামের চারিদিকে তখন বড় বড় কাঠের Bullies সিঁড়ি। বড় লাটের বাড়ি কিছুটা আরম্ভ হয়েছে। North Block হয়ে গিয়েছিলো। South Block তখন ও পুরো হয়নি। দূরে War Memorial Archটি উঠছিল। Gol Post Office থেকে সোজা কনট প্লেসের রাস্তায় Regal সিনেমা সবে খুলেছিল— আর রিজ Road দিয়ে সোজা টালকাটরা পার্ক। সেখানে একটি বাঙ্গালীদের ক্লাব।
আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে তখন ছোট রেললাইন তার ওপর দিয়ে ছোট বড় ইঞ্জিন পাহাড়ের থেকে ভাঙ্গা পাথর নিয়ে যেত— সোজা Talkatara হয়ে Alexandra Place দিয়ে Queen Victoria Road এর উপর দিয়ে পুরাণ কেল্লার কাছ পর্যন্ত রেললাইন। পুরানো কেল্লার আগে একটা stadium হবার জন্য অনেক পাথর ওখানে নিয়ে যাওয়া হতো। ছোট্ট engine এর নম্বর এক, দুই, তিন, এগারো ছিল— বড়টার নম্বর ছিল সাত। আকারে বড় লাইন ছিল মিটার গেজের।
বাড়ীর সামনে রাস্তার ওপারে পাহাড় – Ridge— এখানে শীতের সময় অনেক জঙ্গলী কুল গাছ আর বেশ টক মিষ্টি কুল। আমরা কয়েকজন বেশ ঘন্টার পর ঘণ্টা রৌদ্র ছায়ায় ঘুরতাম, কোথায় কে কত ভাল মিষ্টি কুল পাওয়া যায় জঙ্গলী কুল টক মিষ্টি। আমরা পাহাড়ে পাকদন্দি বা যেখানে সেখান দিয়েই উঠতাম। তবে একটু দক্ষিণে ৩ নং Ridge Road-এর বাড়ির কাছের একটা রাস্তা Ridge Road-এ উপরে যেত। বেশ দূরে একটা জলের বড় ট্যাঙ্ক ছিল যেখান থেকে জল পাম্প করে আসতো আমাদের সব বাড়িতে। রাস্তার ডান দিকে এই জলের ট্যাঙ্ক যেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। তার বাঁ দিকে বেশ ঘন জঙ্গল ছিল— তার মধ্যে অনেক পলাশ গাছ। মনে পড়ে সত্যি Flame of the Forest—কত ঘন লাল ফুলেভরা। এরই মধ্যে দিয়ে একটা ঘোড়ায় চড়বার রাস্তা ছিল, কাঠের কুচানো বেশ নরম পথ— শুনতাম এটি সোজা গিয়েছে Roshanara Gardens এর দিকে। উত্তরে আর অন্য দিকে Talkatara Park-এর কাছে। মাঝে মাঝে দু একজন ইংরাজ মহিলা ও লোককে দেখেছি বেশ মন্থর গতিতে চলতে। এই Ridgeটি নাকি রাজপুতানার আরাবল্লীর পর্বতমালার শেষপ্রান্ত।
এই সময়ে গ্রীষ্মকালে রাইসিনায় ভীষণ গরম পড়তো আমরা ছোট বলে বোধহয় বেশি গরম লাগতো না । দুপুরে পাখার নিচে, রাত্রে খোলা মাঠে সামনে বা ভিতরে উঠোনের বাগানে আমরা শুতাম। তবে মনে পড়ে আঁধির কথা।
প্রায় ৪টা থেকে ৫টা বৈকালে হঠাৎ পশ্চিম দিকে horizon-এর থেকে উপরে উঠতে আকাশ ভরা লালচে গৈরিক রঙের মেঘের মত। সঙ্গে সঙ্গে কাকদের চিৎকার কা কা বলা ও এদিক ওদিক ওড়া খুব চাঞ্চল্যের সঙ্গে। সেই ঘন মেঘ খুব শীঘ্র গতিতে উঠতে উঠতে আকাশে মাথার উপরে পৌঁছে যেত। এর পরে আসতো ধুলার ঝড়, বাইরে দাড়ানো খুবই মুশকিল হতো। চেষ্টা করতাম কিন্তু পশ্চিম থেকে হাওয়ার বেগ ঠেলে দিত পিছনে। তারপর সঙ্গে আসতো প্রচুর ধুলো। মুখ, চোখ, কান ধুলোয় যেত ভরে। বাড়ির দরজা বন্ধ থাকলে খোলা মুশকিল কারণ বাড়ির ভিতর ঝড় যাতে না ডেকে কোনো রকমে। আঁধি আরম্ভ হতেই একটু পরেই আমরা পালাতম বাড়ির ভিতর। ছিটকানী বন্ধ দরজাগুলিতে সেই হাওয়া খালি ধাক্কা দিত “খোলো” “খোলো” যেন বলত। কাঁচের জানলার বাইরে কিছুই দেখা যেত না, খালি লাল ধুলোর ঝড়ের স্রোত বা cyclone মত মনে হত। প্রায় আধ ঘন্টা পরে আস্তে আস্তে ঝড়ের ক্রোধ কমে বন্ধ হলে তখন হঠাৎ প্রচুর জোরে বৃষ্টি হতো— কখনো কখনো। কখনো তাও হতো না— রুদ্ধ গরম থাকতো ও প্রায় বারোটা / একটা রাত্রি পর্যন্ত গরমে গা জ্বালা করতো। তবে জল কলে থাকতো প্রচুর— আর আমরা বিকাল থেকে প্রায় তিন চার বার স্নান করতাম— ঘর থেকে ধুলো পরিষ্কার করা ছিল আর এক বিশেষ সমস্যা। তবে পশ্চিম আকাশে তীব্র গতিতে লালমেঘের মত ধুলোর ঝড় যেরকম আকাশ অধিকার করে নিত আর তার নিচে কাক, চীল ও অন্য পাখিদের ভীতগ্রস্ত ইতঃস্তত ওড়া ও তাদের ডাক দরজার ওপরে, খালি ধাক্কা যেন কোনও অদৃশ্য লোকের দরজার ওপর রাগ— এই দৃশ্য ও আওয়াজ আমার চোখে এখনো ভাসে ও কানে যেন শুনতে পাই।অনেক বছর পর ১৯৫৭ সালে মে মাসে জম্মুতে যখন আমি একলা থাকতাম— তার ২৬ নং ডিভিসানাল রেজিমেন্ট এর কর্নেল ছিলাম— তখন সন্ধ্যার পূর্বে বেড়াতে গিয়েছিলাম যেখানে আমরা grenade ফেলবার range-এ তার পর দিন সৈন্যদের নিয়ে যাব। চারদিকে বালি হঠাৎ ঠিক পুরানো রাইসিনার আঁধির মত লাল ধুলার মেঘ পশ্চিমের আকাশে বেশ তাড়াতাড়ি উপরের দিকে ছুটতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে সেই কাকদের ডাক আর কিছু পরেই ধূলার ঝড়ের স্রোত। তার মুখে নিজেকে এগোতে গিয়ে বেশ মজা লাগছিল কারণ ঝড়ের বেগ আমাকে ঠেলে দিচ্ছিল। যাই হোক প্রায় আধ ঘন্টার বেশি এই ঝড় ছিল না। তবে পুরোনো স্মৃতি রাইসিনার আবার প্রকাশ দেখে ভালই লেগেছিল। কারণ রাইসিনাতে ১৯৩০ এর পর সেই রকম আঁধি আর হয় নি- আস পাশের গ্রামের পল্লী ও ক্ষেত হয়ে উঠেছিল— শস্য, সবজির বাগানে।
IV
তখন বাজার ছিল একটিই নাম তার ‘গোল মার্কেট’। ভিতরে কয়েকটি সবজি, ফলের দোকান ও একজন মুসলমানের মাংসের দোকান। বাইরে যেখানে আটা, চাল, ঘি ইত্যাদির দোকান ছিল, তার কাছে একটি ছোট দোকানে একজন শিখ মাংস বিক্রি করতো। মুসলমানরা হালাল করে মাংস পরে কাটতো আর শিখেরা ঠিক উল্টো হালাল না করে জবাই। যাই হোক ভাল মাংস আট আনা সের ছিল। আর ভাল মাংস পাওয়া যেত আজমিরি গেটে। আমরা বড় পরিবার— বাবা তিন সের করে মাংস আনতেন। বড়দিনে গ্রামফেট বা দুম্বা মাংস একটু ঠান্ডা হলেই জমে যেত ঘি বা চর্বিতে ভরা তবে গরম গরম রুটি দিয়ে খেতে অমৃত লাগতো, খিদেও হতো তো প্রচুর। ১২ থেকে ১৮ খানা রুটি আমরা ভাইরা খেতুম। মাছ ওখলা থেকে ফেরি করে ‘সাধু’ বলে একজন মুসলমান বিক্রি করতো। প্রায় জোর করেই দিত মাছের মাথা ফ্রী। মাছও ছিল আট আনা সের। খুব ভাল আটা, টাকায় আট সের, সুন্দর বাসমতী চাল সাত টাকা মণ আর ঘি দু টাকা সের। মাসকাবারের বাজার বাবা শহর থেকে আনতেন, সঙ্গে আমি যেতাম টঙ্গা করে।
তখন টঙ্গার বাধা সরকারি রেট ছিল ১২ আনা, ৬ আনা— প্রথম ও পরের ঘন্টার। পাশকুয়া ও খারিবাওলি থেকে আটা, চাল, মসলা, ঘি ইত্যাদি, পাশেই বড় সবজির দোকান থেকে প্রায় ১/২ মণ আলু ও অন্য সবজি পরে চাঁদনী চক থেকে মিষ্টি, সন হালুয়া, লাড্ডু আর মার জন্য নানারকম ডাল ভাজা— ঘাণ্টেওয়ালার দোকান থেকে। তারপর ফোয়ারার পাশ দিয়ে চাঁদনী চক দিয়ে নয়া সড়ক, চৌড়ীবাজার, আজমিরি গেট, আর ধূ ধূ করা রাস্তা যেটা পরে Minto Road হলো— যেখান দিয়ে গোল পোস্ট অফিসের সোজা পশ্চিম রাস্তা— Havelok Square, Dalhousie Square, Ranjit Place
Ridge Road-
বাড়ি। শহরে গেলে বাবা একটা Hindustan Times কাগজ কিনতেন। বাড়িতে আমরা পড়তাম The Pioneer। কারণ বাবা Agraয় জন্ম ও পরে কানপুর, কনৌজ ইত্যাদি জায়গায় কাজ করতে করতে Pioneer এ পড়তে অভ্যস্ত ছিলেন। তখন দিল্লিতে অন্য ইংরাজী দৈনিক বের হয়নি।
Ridge-এর ওপরে আমাদের বাড়ি থেকে কিছু উত্তরের দিকে ওই রাস্তায় অনেক পাহাড় ভেঙে flat করা হচ্ছিল। রোজ সকালে দল বেঁধে দিল্লির গ্রামের মেয়েরা গান করতে করতে আসতো। গরমের সময় দুপুরে ২/১ জন আমাদের বাড়ির বারান্দায় খাবার জন্য বসত। শুকনো ২টি বা ৩টি মোটা রুটি (প্রায় আধ ইঞ্চি মোটা) কাঁচা পেঁয়াজ আর লাল লঙ্কা এই ছিল ওদের খাবার। কথা বললে খুব হাসতো কারণ ঠিক হিন্দী তো বলতো না ওরা Gujar জাত, একটু হিন্দির অপভ্রংশ বেশ মিষ্টি কথা। যাই হক শুনলাম ওরা কাজ করছে একটা মন্দির
হবে বলে— – বিড়লা এই মন্দির গড়াচ্ছেন। মেয়ে কামিনরা ছ আনা দৈনিক পেত আর পুরুষরা পেত আট আনা । এর থেকে প্রত্যেককে কিন্তু রোজ মন্দিরের জন্য এক আনা দিতে হতো। আমার এইটা তখনও অল্প বয়স হলেও খারাপ লেগেছিল। শুনেছিলাম বিড়লা ত ধনী লোক। এইরকম বাধ্য পয়সা কাটা অন্যায়। জোর করে মনে হয়েছিল এবং এই মন্দিরের ওপর কোনও শ্রদ্ধা আমার হয় নি। তবে সন্ধ্যায় যখন পুরুষ আর মেয়েরা আলাদা আলাদা দল বেঁধে দক্ষিণ দিকে সামনের রাস্তা দিয়ে গান করতে করতে যেত তখন ভারী ভাল লাগতো তাদের গানের শব্দ ও চলার ভঙ্গি। কিছুটা যেন নাচের মত এবং দুলে দুলে মাথায় থাকতো লোহার কড়াই যাতে ওরা পাথর, চাঙড় নিয়ে যেত ছড়াবার জন্য। আসতো বেশ দূর থেকে। কোথায় ঠিক দেখিনি।
১৯২৪ সালে বোধহয় মার্চ মাসে বাবা ঠিক করলেন আমায় স্কুলে ভর্তি করবেন। তখন এখন যেটা Willingdon Nursing Home সেখানে MB School আর বাঙালিদের একটি স্কুল তৈরি হয়েছে। বাঙালি স্কুলে ভর্তি হবো বাবার সঙ্গে সকালে যাচ্ছি একদিন। পথে একজন বাবাকে এসে কী বললেন। শুনলাম বাবাদের অফিসের একজনের স্ত্রী সকালে কেরসিনের আগুনে আত্মহত্যা করেছেন বোধহয় তুঘলক প্লেসে। বাবা আমায় বাড়ি ফিরে যেতে বললেন কারণ তিনি সেখানে গেলেন সাহায্যের জন্য। কাজেই প্রথম দিন আমার Regular school-এ যাওয়ায় বাঁধা পড়ায় আমি মোটেও দুঃখিত হই নি। আগেই বলেছি যে Rangoon এ আমার স্কুল মোটেই ভাল লাগে নি।
আমাদের বাড়ির উত্তরে Ranjit Place। তার ১ নং বাড়িতে থাকতেন সুব্রত চক্রবর্তী— বাবারই অফিসের সহযোগী। আমার বাবার শিক্ষামত সকলকেই কাকাবাবু বলতাম আর তাঁদের স্ত্রীরা ছিলেন আমাদের কাকিমা। বিজয়ার দিন আমরা সব কাকা, কাকিমাদের প্রণাম করতাম। বাবা ব্রাহ্মণ অব্রাহ্মণ মানতেন না ও আমাদেরো সেইরকম নির্দেশ দিয়েছিলেন।
এই ১ নং Ranjit Place-এ সুব্রত বাবুর ছেলে দুলু বা সুকুমার আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে উঠেছিল। সুব্রত বাবুর আত্মীয় ছিল অজিতদা— তিনি ওই বাংলা স্কুলের বোধহয় তখন class 8-এ। তখন Headmaster ছিলেন গাঙ্গুলী মহাশয়। বাবার কথায় ২/১ দিন পরে অজিতদাই আমায় স্কুলে class-4 ভর্তি করেছিলেন। কয়েকদিন পরেই পরীক্ষা। ক্লাশ করার কথা মাত্র মনে পড়ে গম্ভীর ও শান্ত গাঙ্গুলী মহাশয়ের ক্লাশ । আমি পিছনের বেঞ্চে বসতাম, শুনতাম, কিছুই বুঝতাম না— কেউ আমাকে কোনও প্রশ্নও করত না।
পরীক্ষার মধ্যে খালি অঙ্কের দিনের কথা মনে পড়ে। আমি তখন শুধু যোগ, বিয়োগ জানতাম। পরীক্ষার দিন বাবা দেখলেন যে আমাদের গুণ ও ভাগ ইত্যাদিও আছে, সেইদিন সকালেই বাবা আমাকে গুণ ও ভাগ করতে শেখালেন। শিখলাম চোখের জলে ও কয়েকটি চড়ের সঙ্গে। পরীক্ষার সময় কিন্তু সোজা যোগ, বিয়োগ বা গুণ ভাগ কিছুই ছিল না। প্রশ্নপত্রে টাকা, আনা, পাই এর যোগ ও কয়েকটি যাকে বলে সরল বা বুদ্ধির অংক। আমি তো একটাও পারলাম না। মনে আছে খাতায় লিখছি এমন সময় দেখলাম ২/১ জন আরো কাগজ চেয়ে নিলো। আমি ভাবলুম এটাই বোধহয় নিয়ম— তাই আমিও একটা extra কাগজ চাইলাম ও সত্যিই পেলাম। তবে ওই নাম লেখাই হলো !
মনে পড়ে, পরীক্ষার Result class এতে। শিক্ষক ননীবাবু নাম ডাকছেন, নম্বর বলছেন। আমার অংকে শূন্য নম্বর আশ্চর্য লাগে নি তবে লজ্জায় মুখটা গরম হয়ে উঠেছিল। অন্য বিষয়ে শুনলাম পাস করেছি। যাইহোক বাড়ীতে বাবার কাছে প্রহার খাই নি। এই পরীক্ষার পরেই আমরা বাবার ছুটিতে কলকাতায় আসি। দুপাশের সেই মাঠ আর রেললাইনে সঙ্গে সঙ্গে চলছে অনেক বড় বড় মনসা গাছ। পথে আমার বড় জ্যাঠামশাই বোধহয় আলিগড় থেকে উঠলেন উনিও যাবেন। কলকাতায় ওনার ছোট মেয়ের বিবাহ। সবাই একত্র হলো, ঠাকুরদা সব প্রবাসী ছেলে ও নাতি নাতনীদের নিয়ে খুবই আনন্দ করলেন।
যাই হোক মনে আছে train-এ তে জ্যাঠামহাশয় আমার পড়াশুনার কথা জিগ্যেস করলেন। খুব সরল ভাবেই আমি তাঁকে বললাম যে অংকে আমি শূন্য পেয়েছি। তিনি খুবই গম্ভীর, দাড়ি তাঁর সাদা সকলেই তাঁকে সমীহ করতাম। আমার অঙ্কের শূন্য পাওয়া শুনেই তিনি বললেন ‘তবে আর কী এবার গুড় মুড়ি খাও’। প্রথমে আমি কিছুই বুঝিনি— পরে মনে হলো উনি বোধহয় বাবা মার ওপর কটাক্ষ করছেন। কারণ আমার দাদামশাই বর্ধমানের গীধগ্রামের লোক— গুড়, মুড়ি, ক্ষীর ইত্যাদিই তাঁর প্রিয় ছিল— নিজেই প্রচুর জমির চাষ করতেন। এইটা ভেবে আমার মনে হল যে, জ্যাঠামশাই ঠিক করেছেন যে আমার কিছুই পড়াশুনায় উন্নতি হতে পারে না। এত সহজেই সত্য বলায় এই রকম উপহাস আমার মোটেই ভাল লাগেনি। অত অল্প বয়সেতেও (প্রায় সাত) আমার কি রকম তাঁর প্রতি এই কথাতেই শ্রদ্ধা চলে গেল।
কলকাতা থেকে ফিরে এসে আমি আবার স্কুলে যেতে লাগলাম। বোধহয় ক্লাস ৪ এই। আমার ছোট ভাই রবি সেও Class I এ ভর্তি হলো— সে আমার চেয়ে প্রায় ২২/, বছরের ছোট। পড়াশুনা ভাল হতো না বলে একজন Private Tutor রাখা হলো । তিনি আমাকে ও আমার ছোট ভগিনী হেমলতাকে পড়াতে আসতেন সন্ধ্যায়। মনে পড়ে তার মুখ দিয়ে দুধ ও চিনি খাওয়ার গন্ধ পেতাম। তখন আমার স্থির ধারনা যে আমার বুদ্ধি খুবই কম। কোনও রকমে ক্লাসে পড়তে লাগলাম। তবে অনেক বন্ধু হলো— সুকুমার, বিরাজ, শীতাংশু, সত্যব্রত ইত্যাদি।
১৯২৬ সাল থেকে আমার খুব Malaria জ্বর হতে লাগলো। ভীষণ কাঁপুনি আসতো, লেপের উপর লেপ, তার পর ছোট ভাই বোন কেউ চাপতো। মনে পড়ে ১০৮.২০ পর্যন্ত একবার হয়েছিল। ঠিক কাঁপুনি ছাড়ার পর জ্বর উঠত খুব বেশি আর একঘন্টায় অনেক সময় normal হয়ে যেত। বেশ দুর্বল হয়ে গিয়েছিলাম। অনেক quinine mixture খাওয়া আর হর্ষবাবুর কাছ থেকে Homeopathic Medicare খাওয়া। কিছুতেই এই জ্বর আমায় ছাড়ত না। প্রায় প্রতি সপ্তাহে হতো।
এই জ্বরের সময় এক রাতের কথা মনে পড়ে। সকলে ঘুমচ্ছে। আমরা একটা বড় মশারীর ভিতরে ভাই বোন শুয়ে আছি। একটি ছোট power-এর বিজলীর আলো আছে। আমার ঘুম ভেঙে গেল। কী জানি কেন, মশারী খুলে ফেললাম। তারপরে সেটা এক কোনায় রেখে দেখলাম আলো পাখার switch। তখন পাখার regu lator উপরে খোলা থাকতো আর knobটা সরিয়ে পাখা আস্তে বা জোরে করা যেত। আমার সেই regulator-এর গর্ভে আঙুল যেন দিতেই হবে কী হয় দেখার কৌতুহল। মনে পড়ে খুব জোরে shock, তৃপ্ত হয়ে, কৌতুহল মিটিয়ে আবার শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
হর্ষকাকাবাবু Ranjit Place এই থাকতেন— বোধহয় ১৫ নং এ। রোজ সকালে উনি সকলকে homeopathy-র ওষুধ দিতেন। আমাদের ভাই বোনের আর আমার নিজের জন্যে ওর কাছ থেকে ওষুধ আনা আমার কাজ ছিল – স্কুলে যাবার আগে। একদিন অনেককে অনেক রকম প্রশ্ন করে উনি খুব যত্ন করে পুড়িয়া বানিয়ে দিলেন— আমি ওর শেষ patient। ওষুধ তৈরি করছেন আর বলছেন homeopathy ওষুধ কত ভাল— সব রকম চিকিৎসাক করতে পারে। মনে পড়ে জিজ্ঞাসা করলুম। কাকবাবু বুদ্ধি বাড়ার ওষুধ আছে? উনি একটু চুপ করে বললেন হ্যাঁ আছে তো। বাড়ি গিয়ে তারপর বাবাকে একদিন একলা পেয়ে আমি বলেছিলাম— হর্ষকাকবাবু বলেছেন বুদ্ধি বাড়ার ওষুধ আছে— আমার তাই খেলে হয় না? বাবা এর কোনও উত্তর-ই দিলেন না। মনে হল হায়রে কেউ-ই চায় না যে আমার বুদ্ধি একটু বারে, আমি ক্লাশের পড়া একটু ভাল করতে পারি।
১৯২৬/২৭ সালে বাবা ঠিক করলেন যে আমায় change-এ পাঠাবেন । আমার জ্যাঠামশাই এর ছেলে মণিদাদা ও আমার ননীদাদা কলিকাতা থেকে এসেছিলেন। আমার দাদা কলিকাতাই পড়তেন college-এ। উনি Philosophy-তে MA পড়ে Professor হবেন। সরকারী কাজ কেরানিগীরি উনি পছন্দ করতেন। যাই হোক ওদের সঙ্গে আমার বিষয় কথা বলছেন। আমি ঘরের বাইরে শুনছি। আমার কোলে আমার ছোট্ট ভাই অমরেন্দ্র। আমি তাকে চুপ করাচ্ছি। খুব কৌতুহল বাবা কী ঠিক করেন। শুনলাম যাবই ওদের সঙ্গে। আর বাবা আমার অঙ্কের দুর্বলতার কথা বললেন আর সঙ্গে সঙ্গে বললেন যে, আমি বেশ ‘intelligent’। আমি ইংরাজীতে intelligent মানে বুদ্ধিমান বা প্রখর জানতাম। এই প্রথম নিজের বিষয় একটু ভাল কথা তাও আমার বাবার মুখে শুনে খুব আনন্দ হয়েছিল। আর আমি যে ভাল তা প্রমাণ করার জন্য আমার ছোট ভাইটি যে আমার কোলে ছিল আমি অনেক কষ্ট ও চেষ্টা করে শান্ত করতে লাগলাম— আর সেখান থেকে সরে গেলাম। এই আমার প্রথম prize আমার মনে হল তাও আমার বাবার কাছ থেকে।
এই সময়ের আগে আমি আমার মার কাছে দুপুর বেলায় ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ শুনতাম । মা বেশ পড়তেন- বাবার কেনা বই। এ ছাড়া কাশীদাশী মহাভারতের দুটি বই আমার অনেকবার পড়া ও বেশ কয়েকটি জায়গা মুখস্ত হয়ে গিয়েছিলো আপনিই। বাড়ীতে সত্য নারায়ণের একটি ছবি আমার বড় প্রিয় ছিল— শ্রী, সৌন্দর্য ও বন্ধুত্বয় ছবিটি মাখা মনে হতো। এছাড়া মা ব্রত করতেন আর ‘মেয়েদের বতকথা’ বলে একটি বই যা মা পড়তেন আমার খুব ভাল লাগতো। বাংলায় আশুতোষের আত্মজীবনীর মতন কয়েকটি বাংলা বই বাবা আমায় কিনে দিয়েছিলেন। বেশ শ্রদ্ধা আসতো এই সকল মহৎ লোকেদের বিষয় পড়ে। যাই হোক আমার বন্ধুদের ছেড়ে কলকাতায় আসতে আমার বেশ কষ্ট হয়েছিল। কলকাতায় এসে কিন্তু আমার জ্বর সত্যিই বন্ধ হল— আমি প্রথমে Pyrex ও পরে আমার মেজদার দেওয়া Arsenic Album 30 খেয়েছিলাম ।
আমি এক বৎসর আমার ঠাকুরদাদা— ঠাকুরমার কাছে হরিনাভিতে ও বর্ষাকালে কলিকাতায় থাকি। এই সময়ের কয়েকটি কথা যা খুবই মনে লেগেছিল তা লিখছি।
২৭/১/৭৮.